জুয়া ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামের দিকনির্দেশনা

সম্পদ ও বিবেক একজন মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয়। সম্পদ মানুষের নিজ প্রয়োজনীয় অনেক চাহিদা পূরণ করে এবং সম্মানের সাথে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি বিবেক-বুদ্ধি মানুষের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদির মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে সহযোগিতা করে। যদিও একমাত্র বিবেক বুদ্ধিই সব সময় ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম নয়। বিবেক বুদ্ধির বাইরেও ভাল-মন্দের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য আরেকটি জিনিসের দরকার। আর তা হল, মহান স্রষ্টা আল্লাহ কর্তৃক দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তাআলার এই দিকনির্দেশনার নামই হল ‘আল-কুরআন’। আর এই দিকনির্দেশনার বাস্তব রূপদানকারী হলেন মানবতার মুক্তিদূত বিশ্বনবী রহমাতুল লিল-আলামিন হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.।মহান আল্লাহর ঘোষণা- ‘সাবধান! হুকুম প্রদানের ক্ষমতা তাঁরই। আর তিনি হচ্ছেন খুব দ্রুত হিসাবকারী।’ {সূরা ৬ আনআম, আয়াত-৬২}

কথা হচ্ছিল সম্পদ ও বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে। এই দুইটি জিনিস পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে এবং সম্মান নিয়ে সত্যিকারের ভদ্র-শালীন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আল-কুরআন সম্পদের সুষ্ঠু আয়-ব্যয়, বণ্টন ও ভোগের যেমন নিয়মাবলী বর্ণনা করেছে, অনুরূপভাবে বিবেক-বুদ্ধি সুস্থ রাখার প্রতিও জোর তাগিদ দিয়েছে। সম্পদের ক্ষতি হওয়ার যত পথ আছে, তন্মধ্যে অন্যতম হল ‘জুয়া’। আর বিবেক-বুদ্ধি ধ্বংস হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল ‘মদ্যপান বা মাদকাসক্তি’। তাই আল-কুরআন প্রথমে জুয়া ও মদ্যপানের দরুণ যেসব পাপ ও ফাসাদ সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনা দিয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে- ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে। বল, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এভাবে আল¬াহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপারে।’ {সূরা ২ বাকারা, আয়াত-২১৯}

মদ্যপানকে পর্যায়ক্রমিকভাবে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম হচ্ছে এই যে, মদ্যপান সম্পর্কে চারটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে আলোচ্য এ আয়াতটি সর্বপ্রথম নির্দেশ। এতে মদ্যপান ও জুয়ার মাধ্যমে যেসব পাপ ও ফাসাদ সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়েছে, মদ্যপান হারাম করা হয়নি। বরং এ আয়াতটিকে এই মর্মে একটা পরামর্শ বলা যেতে পারে যে, এটা বর্জনীয় বস্ত্ত। কিন্তু বর্জন করার কোন নির্দেশ এতে দেয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় আয়াত হচ্ছে- ‘হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল।’ {সূরা ৪ নিসা, আয়াত-৪৩} এতে বিশেষভাবে নামাযের সময় মদ্যপানকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য সময়ের জন্য অনুমতি রয়ে যায়। মদ্যপান চিরতরে নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আল-কুরআনে বর্ণিত তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াত হচ্ছে সূরা আল-মায়েদায়। এতে পরিস্কার ও কঠোরভাবে মদ্যপান নিষিদ্ধ ও হারাম করে দেয়া হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ! এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক তীরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে না কি?’ {সূরা ৫ মায়েদা, আয়াত-৯০-৯১}

এ বিষয়ে শরীয়তের এমন পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ ছিল এই যে, আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করা বিশেষত: নেশাজনিত অভ্যাস হঠাৎ ত্যাগ করা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। যেভাবে শিশুদেরকে মায়ের বুকের দুধ ছাড়ানো কঠিন ও কষ্টকর। তেমনি মানুষের অভ্যাসগত কোন কাজ ছাড়ানো এর চাইতেও কষ্টকর। তাই ইসলাম একান্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথমে মদ্যপানের মন্দ দিকগুলো মানবমনে বদ্ধমূল করেছে। এরপর নামাযের সময়ে একে নিষিদ্ধ করেছে এবং সবশেষে কঠোরভাবে সর্বকালের জন্য নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে।উল্লেখিত চারটি আয়াতের মাধ্যমে তিনটি পর্যায় বিবৃত হয়েছে। প্রথমত: সতর্কীকরণ। দ্বিতীয়ত: বিশেষ সময়ের নিষেধাজ্ঞা এবং তৃতীয়ত একেবারে বর্জন।

সম্পদ ও বিবেক-বুদ্ধি ধ্বংসের অন্যতম মাধ্যম হল ‘মদ ও জুয়া’। অথচ আজকাল অনেক মানুষের মাঝে এই মদ্যপান বা মাদকাসক্তি এবং জুয়া খেলা বা জুয়ায় অংশ নেয়া ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। টাকাওয়ালা ব্যক্তিরা এটাকে ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। আর গরীব লোকেরা অনেকে জুয়া খেলা বা জুয়ায় অংশ নেয়াকে উপার্জনের মাধ্যম মনে করে। মদ ও জুয়া উভয়টাই নেশা। নেশার ধর্ম তৃধর্মীয়। উর্ধগাম, নিম্নগামী ও সমান্তরাল। একটু পরিস্কার করে বলি, মানুষের যখন টাকা-পয়সা বেশি হয়, তথা সম্পদ উর্ধমুখী হয়, তখনও নেশা তাকে আকর্ষণ করে। আবার মানুষের যখন টাকা-পয়সা কমে যায় তথা সম্পদ নিম্নগামী হয়, তখনও নেশা তাকে আকর্ষণ করে। অর্থাৎ সুখে এবং দুখে উভয় অবস্থাতেই নেশা তাকে আকর্ষণ করে।টাকা পয়সা বেশি হলে শয়তান অন্তরে কু-মন্ত্রনা দেয়, এত টাকা খরচ করবে কোথায়! আবার টাকা-পয়সা কমে গেলেও শয়তান কু-মন্ত্রনা দেয়, হায় আফসোস! তোমার মত দুঃখী আর অভাবী কেউ নেই। তাই চলো, নেশা করো।নেশার আরেক ধর্ম সমান্তরাল। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থাতেও নেশা মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে। শয়তান তখন কু-মন্ত্রনা দেয়, কেন তোমার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, তাই নেশা কর।
নেশামুক্ত ও জুয়ামুক্ত জীবন গড়তে প্রথমে যা জরুরী, তা হল মানসিকতার পরিবর্তন। ইসলাম এই কাজটিই করেছে। হুজুর সা.-এর শিক্ষায় সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুর মানসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, মদ্যপানরত অবস্থায় যখন জনৈক সাহাবী সংবাদ দিলেন যে, ‘মদ হারাম করা হয়েছে’, তখন সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম মদের পেয়ালা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, পেয়ালা ভেঙ্গে ফেললেন।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৪২৫৪}

যেদিন মদ হারাম ঘোষণা করা হল, সেদিন মদীনার সমস্ত অলিগলিতে দামি দামি মদের ঢল বয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করলেন- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ্যপান করবে, অতপর মদ্যপান থেকে তাওবা না করেই মৃত্যুবরণ করবে, সে আখেরাতে বঞ্চিত হবে।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৫১৪৭}

মানুষ তার সীমিত জ্ঞান দিয়ে বুঝতে সক্ষম নয় যে, কোনটি তার জন্য ভাল, আর কোনটি তার জন্য মন্দ। উপস্থিত বিবেচনায় মানুষ অনেক ভালকে মন্দ জ্ঞান করে, আবার অনেক মন্দকে ভাল জ্ঞান করে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘ এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্ল¬াহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ {সূরা ২ বাকারা, আয়াত-২১৬} মদ ও জুয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বোকা মানুষ এই বিভ্রান্তির শিকার হয়। তাই কুরআন বলেছে, তোমরা তোমাদের বুঝ অনুযায়ী মনে কর যে, মদ ও জুয়াতে অনেক উপকারিতা নিহিত আছে। মূলত মদ ও জুয়ার উপকারিতার চাইতে ক্ষতিই বেশি, যা তোমরা বুঝতে পারছো না।

আজকাল যুব সমাজের মাঝে মাদকাসক্তির সয়লাব। ডিশ কালচারের এই যুগে বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে মদ্যপান, অশ্লীল নৃত্য ইত্যাদির আকর্ষণীয় উপস্থাপনা চলছে। এতে করে যুব সমাজের মনে এগুলোর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে সে এগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাইরের পরিবেশ মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে। মানুষের মন তার দেহের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ দেহ মনের অবস্থা তার কার্যকলাপ দিয়ে প্রকাশ করে। তাই বাইরের পরিবেশটা সুস্থ-সুন্দর শালীন হওয়া বাঞ্চনীয়। পিতা যদি সিগারেট খায়, এতে তার সন্তানও মনের অগোচরে সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এখানে সন্তানের সিগারেট না খাওয়ার জন্য পিতার সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত থাকাটা প্রধান শর্ত।

তাই ইসলাম মদ ও জুয়ার ক্ষতি সম্পর্কে সতর্কীকরণ করে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তারপর বিশেষভাবে শুধুমাত্র নামাযের সময় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে করে মদ ও জুয়ায় অভ্যস্ত লোকদের নামায পড়ার পাশাপাশি বেশি বেশি এমন কাজ ও পরিবেশে অংশ নেয়া প্রয়োজন, যে পরিবেশে মাদক গ্রহণ করা যায় না। যেমন বেশি বেশি মসজিদের পরিবেশে থাকা। বিশেষ করে তাবলীগ জামাতের সাথে সময় লাগানো। এতে করে সে সুন্দর একটা মসজিদের পরিবেশে থাকার সুযোগ পাবে এবং অনেক মন্দ অভ্যাস থেকে সে মুক্ত থাকতে পারবে।

মদ ও জুয়ার শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই ভোগ করতে হবে। দুনিয়ার শাস্তির চাইতে আখেরাতের শাস্তি অনেক ভয়াবহ। মদ ও জুয়ার শাস্তি তো প্রথমে তার নিজের শরীর থেকে আরম্ভ হয়। মদ্যপানে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং জুয়ার মাধ্যমেও সে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।জুয়া ও মদ্যপানের ক্ষতি শারীরিক-মানসিক উভয় দিক থেকেই তাকে গ্রাস করে। এরপর মদ ও জুয়ার ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ে তার পরিবারে, তারপর সমাজে। এভাবে জাতীয় জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। তাই আসুন, আমরা আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাই। এজন্য নামায কায়েম করি, সম্পদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করি। তারপরও অতিরিক্ত সম্পদ থেকে গরীব এবং অভাবীদের জন্য খরচ করি। এতে করে আপনার মানসিকতা প্রশান্তি লাভ করবে। মদ ও জুয়ার ভয়াবহ ক্ষতি তেকে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে বেঁচে যাবো। চির প্রশান্তির জায়গা ‘জান্নাত’ লাভ করবো, ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা সেই জান্নাতের সুসংবাদ আমাদেরকে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন- ‘ আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোন ফল খেতে দেয়া হবে, তারা বলবে, এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেয়া হয়েছিল। আর তাদেরকে তা দেয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র স্ত্রীগণ এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী।’ {সূরা ২ বাকারা, আয়াত-২৫}

লেখক,মাওলানা কাজী ফজলুল করিম।
মুহাদ্দিস ও খতীব, কারবালা মাদরাসা, বগুড়া।

Leave a Comment