পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম ও স্থায়ী সম্পর্ক যেসব ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে, তন্মধ্যে মাতা-পিতা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক অন্যতম। এ সম্পর্ক জন্মগত, যা অস্তিত্বের মাঝে বিরাজমান। মানুষ যতদিন তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে, ততদিন সে তার মাঝে স্বীয় মাতা-পিতার নমুনা বহন করবে। সন্তান পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার বহু আগ থেকেই মাতা-পিতার দেহে অবস্থান করে। অনুরূপভাবে মাতা-পিতা অবস্থান করে তার মাতা-পিতার দেহে। এভাবে মানব প্রজন্মের একটি ধারা গিয়ে মিশে যায় পৃথিবীর প্রথম মানব ও মানবী হযরত আদম ও হাওয়া আ.-এর মাঝে। তাই কোন সন্তান যদি তার মাতা-পিতার খেদমত করে, সঠিক মর্যাদা বজায় রাখে, তাহলে বলা যায়, সে যেন গোটা মানব প্রজন্মের খেদমত করল, গোটা মানব জাতিকেই সে সম্মান দেখাল। আর যে ব্যক্তি মাতা-পিতার খেদমত করে না, সঠিক মর্যাদা বজায় রাখে না, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই অবজ্ঞা করল, অসম্মান করল।মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের সাথে গর্ভে ধারণ করে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে।’ {সূরা ৪৬ আহকাফ, আয়াত-১৫} উক্ত আয়াতে মায়ের কষ্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাস্তবেই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পেছনে পিতার চেয়ে মাতার কষ্ট অনেক অনেক গুণ বেশি।সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মাতা-পিতার প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু হক কার্যকর হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই সেই হক অনুযায়ী আমল করা মাতা-পিতার কর্তব্য হয়ে যায়। মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের হক হচ্ছে প্রথমত: তিনটি। জন্মের পরে পরেই তার একটি নাম রাখতে হবে। জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়লে তাকে কুরআন তথা ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। আর সে যখন পূর্ণ বয়স্ক হবে, তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বস্ত্তত সন্তানের ভাল একটি নাম না রাখা, কুরআন ও ইসলামের শিক্ষা না দেয়া এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা, মাতা-পিতার অপরাধের মধ্যে গণ্য। এসব কাজ না করলে মাতা-পিতার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। ভবিষ্যত সমাজও ইসলামী আদর্শ মুতাবিক গড়ে উঠতে পারে না।
অনুরূপভাবে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সপ্তম দিনে আকীকা করাও মাতা-পিতার দায়িত্ব। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নবী করিম সা. সপ্তম দিনে সন্তানের নাম রাখতে, মস্তক মুন্ডন করতে এবং আকীকা করতে আদেশ দিয়েছেন। {তিরমিযী শরীফ, হাদীস-২৭৫৮} আজকাল অনেক মুসলামানের সন্তানের নাম শুনে বোঝার উপায় নেই যে, সে মুসলিম কি না! একজন মুসলমানের নাম শুনেই বোঝা যাবে যে, সে একজন মুসলমান। পোষাক-আষাকেও বোঝা যেতে হবে যে, সে একজন মুসলমান। চাল-চলনে, ওঠা-বসায়, কথা-বার্তায় তথা সকল ক্ষেত্রেই একজন মুসলমান অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সে হবে সুন্নাতে নববীর মূর্তপ্রতীক। মাতা-পিতা যদি সন্তানের হক সঠিকভাবে আদায় করে, তার সুন্দর একটি নাম নির্বাচন করে, ইসলাম শিক্ষা দেয়, সঠিক সময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে, তাহলে ঐ সন্তান কখনো মাতা-পিতার কষ্টের কারণ হতে পারে না। বরং সে হবে মাতা-পিতার চোখের শীতলতা। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা বলে, হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’। {সূরা ২৫ ফুরকান, আয়াত-৭৪}
সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত বলাও মাতা-পিতার দায়িত্ব। হযরত আবু রাফে রাযি. বলেন, ‘হযরত ফাতেমা যখন হুসাইনকে প্রসব করলেন, তখন নবী করীম সা.কে তাঁর কানে নামাযের আযান শোনাতে আমি দেখেছি। {আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৪৪৪১} এখানে একটি বিষয়ের প্রতি ওলামায়ে কেরাম ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা হল, ভূমিষ্ট হওয়ার সময় আযান-ইকামত দেয়া হল। এখন নামায পড়ার পালা। অর্থাৎ মানুষের ভূমিষ্ট হওয়াটাই যেন নামাযের উদ্দেশ্যে। তাই তো হাদীস শরীফে সাত বছর বয়স থেকেই নামাযের আদেশ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামায পড়তে আদেশ কর, যখন তারা সাত বছর বয়সে পৌঁছবে এবং নামাযের জন্য তাদের প্রহার কর (শাসন কর) যখন তারা দশ বছরে উপনিত হবে। আর তখন তাদের জন্য পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করাও কর্তব্য।’ {আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৪১৮}
ভূমিষ্ট হওয়ার পরে পরেই নবজাতকের কানে আযান ও ইকামত দেয়ার বিষয়ে ওলামায়ে কেরাম আরেকটি ইঙ্গিত পেশ করেছেন। তা হল, জানাযার নামাযের কোন আযান-ইকামত নেই। অর্থাৎ ভূমিষ্ট হওয়ার পরপর যে আযান-ইকামত দেয়া হল, তা যেন জানাযা নামাযেরই আযান ও ইকামত। আযান-ইকামত ও নামাযের মাঝে যেমন সময় খুব বেশি থাকে না, অনুরূপভাবে ভূমিষ্ট হওয়া আর মৃত্যু বরণ করার মাঝেও খুব একটা সময় থাকে না। তাই মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্ত্ততি জন্মের পর থেকেই গ্রহণ করা উচিত।
মাতা-পিতা হিসেবে সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বড় যে দায়িত্ব, তা হল তাওহীদ বা একত্ববাদের আদর্শে সন্তানের জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলা। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হযরত লোকমান আ.-এর নসিহত তাঁর পুত্রের প্রতি- বিশেষভাবে স্মরণীয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে প্রিয় পুত্র! আল্লাহর সাথে শিরক কর না। কেননা, শিরক হচ্ছে অত্যন্ত বড় জুলুম।’ {সূরা ৩১ লোকমান, আয়াত-১৩}
মাতা-পিতার উপর সন্তানের জন্য যেমন কিছু করণীয় দায়িত্ব রয়েছে, অনুরূপভাবে সন্তানের উপরও মাতা-পিতার জন্য অবশ্য করণীয় কিছু দায়িত্ব আছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ করেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়জন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে উফ (বিরক্তি, উপেক্ষা, ক্রোধ অথবা ঘৃণাসূচক কোন কথা) বলিও না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলিও। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা অবনত করিও এবং বলিও, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি রহমত নাযিল কর, যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছে।’ {সূরা ১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত-২৩-২৪}
উল্লেখিত আয়াতে প্রথমে আল্লাহকে সর্বোতভাবে এক ও লা-শারীক বলে স্বীকার করার নির্দেশ এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামান্যতম বন্দেগী করতেও স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাতা-পিতার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার। এ দু’টো নির্দেশ একসঙ্গে দেয়ার অর্থ এই যে, প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও মাতা-পিতার বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা ও লালন-পালনকারী তো মহান আল্লাহ। সুতরাং বান্দার উপর সর্বপ্রথম হক তাঁরই ধার্য হবে। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু এ কাজ সরাসরি নিজে করেন না, বরং মাতা-পিতার মাধ্যমে করিয়ে নেন, তাই বান্দার উপর আল্লাহর হকের পরপরই মাতা-পিতার হক ধার্য হবে। মাতা-পিতা কর্তৃক শৈশবে সন্তানের প্রতি যে দরদ-মায়া ও ভালবাসাপূর্ণ আচরণ প্রকাশ পায়, সেই আচরণের কথা স্মরণ করে দিয়ে মহান আল্লাহ মাতা-পিতার প্রতি রহমত কামনা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
মাতা-পিতার জন্য মহান আল্লাহ সরাসরি দুআ করার নির্দেশ দিয়ে তাদের সম্মান যে কত উঁচু- সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। সেই সাথে সন্তানের উচিত, তার শৈশবের অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করা। শৈশবে সে যখন ছিল অসহায়, নিজে নিজে কোন কাজই সে করতে পারত না, তখন যেমন মাতা-পিতা তাকে হাত ধরে ধরে সব কাজ শিখিয়েছেন, তার সুখের জন্য, তার আরামের জন্য নিজের সুখশান্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন, সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়লে মাতা-পিতা অস্থির হয়ে উঠতেন। এইসব কিছু সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার দরদ ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালবাসাপূর্ণ মধুময় সম্পর্ক হল মাতা-পিতা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক। যে মাতা-পিতার মাঝে সন্তানের জন্য এত দয়া, এত মায়া, সেই মাতা-পিতাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ কত দয়ালু তাঁর বান্দার প্রতি সেদিকে বান্দার খেয়াল করা দরকার। তাই তো হযরত লোকমান আ. তাঁর সন্তানের প্রতি প্রথম নির্দেশ দিচ্ছেন, হে বৎস! শিরক করো না, অবশ্যই শিরক মস্ত বড় জুলুম। শিরক যেমন কবীরা গুনাহ, অনুরূপভাবে মাতা-পিতার নাফরমানী করাও কবীরা গুনাহ। তবে মাতা-পিতার ফরমাবরদারী করতে গিয়ে আল্লাহর নাফরমানী করা কোনক্রমেই বৈধ হবে না। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘খালেকের নাফরমানী করে মাখলুকের ফরমাবরদারী করা যাবে না’। {মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১০৪১}
রাসূলুল্লাহ সা. কবীরা গুনাহ কি কি তা বলতে গিয়ে শিরক করা ও মাতা-পিতার নাফরমানী করাকে একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং মাতা-পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ।’ {বুখারী শরীফ, হাদীস-৫৫১৯}
হযরত জাহেমা রাযি. বলেন, আমি রাসূল সা.-এর কাছে জিহাদে শরীক হওয়া সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য উপস্থিত হলাম। তখন রাসূল সা. জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূল সা. বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের সম্মান ও খেদমত করতে থাক। কেননা তার পায়ের নীচেই জান্নাত।’ {নাসাঈ শরীফ, হাদীস-৩০৫৩}
আজ সমাজে মাতা-পিতা ও সন্তানের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা একেবারেই উদাসীন। দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা সর্বদা ইসলামের বিধানসমূহ জলাঞ্জলী দিচ্ছি। আধুনিকতার বিষবাষ্পে আমরা সন্তানদেরকে ইসলামী ভাবধারা থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে দুনিয়ামুখী করে গড়ে তুলছি। এ কারণেই তো আমাদের সন্তানেরা মাতা-পিতাকে এক পর্যায়ে ‘বোঝা’ মনে করে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বৃদ্ধ মাতা-পিতার শেষ আশ্রয় এখন হচ্ছে ‘বৃদ্ধাশ্রমে’।
আমাদের সন্তানকে সঠিক ইসলামী শিক্ষা দিয়ে আমরা যেন তাদের কাছ থেকে ইসলামী নিয়মে সম্মান ও মর্যাদা পাই, সেজন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমাদের সন্তানদেরকেও সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
লেখক,মাওলানা কাজী ফজলুল করিম।
মুহাদ্দিস ও খতীব, কারবালা মাদরাসা, বগুড়া।