রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক কাবার হাতীম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত স্বশরীরে বোরাক যোগে রাত্রিকালীন ভ্রমণকে বলে ‘ইসরা’। আর মসজিদুল আকসা থেকে সপ্তমাকাশের ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পেরিয়ে অসংখ্য নূরের পর্দা ভেদ করে মহান আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি স্বশরীরে সাক্ষাত করাকে বলে ‘মিরাজ’। এই ঘটনা অস্বীকার করা কুফুরী। বুঝে আসুক বা না আসুন, বিজ্ঞান এই ঘটনাকে স্বীকার করুক বা না করুক, কুরআন ও হাদীসে যেহেতু এই ঘটনার স্বীকৃতি রয়েছে, তাই এই ঘটনাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা ঈমানের দাবী। অস্বীকার করা কুফুরী। ইসলামের কোন কিছুই বিজ্ঞানের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে না। বরং ইসলাম নির্ভর করে রাসূল সা.-এর ওপর নাযিলকৃত কুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদীস শরীফের ওপর। বিজ্ঞানের স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে যদি ইসলাম মানা হয়, তাহলে তাকে ইসলাম মানা বলা যায় না, বরং তখন তা হবে বিজ্ঞান মানা। বিজ্ঞানের গবেষণা পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞান প্রদত্ত অতীতের অনেক সূত্রই এখন ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে বিজ্ঞান আজকে যে সূত্রাবলি পেশ করছে, ভবিষ্যতে যে তা নির্ভুলভাবেই থাকবে, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই বলা যায়, বিজ্ঞান এক ধরণের বিশেষ জ্ঞান, যা পরিবর্তনশীল। কিন্তু ইসলামের অকাট্য বিষয়াবলি চির সত্য ও অপরিবর্তনীয়। তাই, ইসলামের বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করাটা এক ধরনের বোকামী। তবে এ কথা সত্য যে, ইসলামের সঙ্গে বিজ্ঞানের অনেক মিল রয়েছে। আবার অনেক বিষয়ে অমিলও রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ জ্বীন জাতির অস্তিত্বের কথা বলা যেতে পারে। বিজ্ঞান আগুনের তৈরি জ্বীন জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। কিন্তু পবিত্র কুরআনে সূরায়ে জ্বীন নামে ভিন্ন একটি সূরাই নাযিল করা হয়েছে। সে যাই হোক, হয়ত একদিন বিজ্ঞান ইসলামের সব কিছুই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে।
ইসলাম ও বিজ্ঞান পরস্পর সম্পর্ক কেমন হবে, এ বিষয়ে মূল কথা হল, বিজ্ঞানকে ইসলামের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে যে, ইসলাম তা সমর্থন করে কি না। অর্থাৎ বিজ্ঞান কোন কিছু সম্ভব বা অসম্ভব বললেই তা বিশ্বাস করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলাম ঐ বিজ্ঞানের স্বীকৃতি না দেয়। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নির্ণয়ে আমরা তিনটি ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগ: বিজ্ঞানের যেসব বিষয় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সমর্থন করে। এগুলো বিশ্বাস করতে কোন অসুবিধা নেই। দ্বিতীয় ভাগ: বিজ্ঞানের ঐসব বিষয়, যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, এগুলো বিশ্বাস করা যাবে না। বরং আমরা অপেক্ষায় রইলাম ঐ দিনের, যেদিন সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোতে বিজ্ঞান ইসলামের মতই বক্তব্য দেবে। তৃতীয় ভাগ: বিজ্ঞানের ঐসব বিষয়, যে বিষয়গুলো সম্পর্কে ইসলাম নিরব থাকে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের যেসব বিষয়ে ইসলামের পক্ষ থেকে কোন উক্তি নেই। এসব বিষয়ে আমাদেরও নিরব থাকা উচিত। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু নেই। শুধু শুনে রাখলাম, জেনে রাখলাম, এতটুকুই।
উপরোক্ত আলোচনার পর বিজ্ঞান মনস্কতায় মিরাজের স্বরূপ নির্ণয়ের পূর্বে ইসলামী মারেফাত বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। ইসলামী মারেফাত বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান সমগ্র সৃষ্টিকে তিনটি আলম বা জগতে বিভক্ত করে। এই তিনটি স্তরের প্রথমটি হচ্ছে ‘আলমে শাহাদাত’ বা ‘আলমে খালক’। এটি হচ্ছে আমাদের এই সৃষ্টি জগত, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। এ জগতের সবকিছুই বস্ত্তকেন্দ্রিক, ইন্দ্রিয় কেন্দ্রিক। বস্ত্ত ও শক্তিসমূহে গড়া শব্দ, রূপ, গন্ধে ভরা এই বস্ত্ত জগত বা জড় জগত। মানুষের জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি এই জগতেরই ব্যাপার। এই জগতের শুরুটা হল পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর দিন থেকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত।
ইসলামী মারেফাতের দৃষ্টিতে সৃষ্টির দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘আলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য জগত। এটি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের অতীত এক সূক্ষ্ম জগত। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিমাপাদির আওতা বহির্ভূত এই জগত। এই জগত আমাদের জানা প্রাকৃতিক নিয়মাদির অতীত। আলমে শাহাদাত বা জড় জগতের সমাপ্তি যেখানে, তার পর থেকেই এই আলমে গায়েব বা অদৃশ্য জগতের শুরু। উর্ধ্বে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এর সীমা। ফেরেশতা পর্যন্ত যার উর্ধ্বে গমন করতে অক্ষম। রূহ বা আত্মার আবাসস্থল, বিধায় এটিকে ‘আলমে আরওয়াহ’ বা রূহানী জগতও বলা হয়।
সবশেষে ইসলামী মারেফাতে বর্ণিত সৃষ্টির তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘আলমে মেছাল’ বা ‘আলমে বরযখ’ বা প্রতিরূপ জগত। এই স্তরটিই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি হচ্ছে পূর্ববর্তী জগত দু’টোরই অবিকল প্রতিরূপ। ঠিক যেন আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। জড় জগত ও রূহানী জগত তথা আলমে শাহাদত ও আলমে গায়েবের জড় ও অজড় সব কিছুই এখানে প্রতিবিম্বিত রূপে বর্তমান। মানুষের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপসহ বিশ্বের সমস্ত ঘটনাবলি এমনকি হায়াত-মউত, জ্ঞান-বিবেক প্রভৃতি যেসব বস্ত্তর কোন দৈহিক আকার বা চেহারা নেই, সেগুলোও এই জগতে রূপ ও বর্ণ গ্রহণ করে সার্বক্ষণিক প্রকাশিত থাকে। রূহ এবং ফেরেশতারা নিম্নতর জগতে দেহহীন হলেও এই জগতে দেহবিশিষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয়। এই জগতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে স্থান ও কাল বলে কিছু নেই। এটা ‘লা-মাকাম ও লা-যামান’-এর স্তর। এখানে অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। এখানে সবকিছুই বর্তমান। প্রবাহহীন কাল এবং সীমাহীন স্থানের এই চির বর্তমানের মধ্যেই বিশ্বের যাবতীয় ঘটনার চিরস্থায়ী সংঘটন। এখানেই ‘লাওহে মাহফুজ’ বা সেই সংরক্ষিত ফলক, যাতে সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত বিশ্বের সবকিছুর রূপ বা চিত্র বিদ্যমান। অর্থাৎ বিশ্বের সবকিছুর তাকদীর সংরক্ষিত রূপে বর্তমান। এই জগত থেকেই নিম্নতর জগতের ঘটনাবলি মহান আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশরূপে প্রথমে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য়, অতপর সেখান থেকে নির্ধারিত ফেরেশতাদের মাধ্যমে আলমে গায়েব এবং আলমে শাহাদাতের সীমাবদ্ধ স্থানের মধ্যে সংঘটিত এবং প্রবাহমান হয়। আর সেটাকেই মানুষ ধারণা করে একটা নতুন ঘটনা তথা নবসৃষ্টি রূপে।
উপরোক্ত ইসলামী মারেফাতের তিনটি জগতের বর্ণনার পর এবার রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইসরা ও মিরাজ কোন কোন জগতকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল, তা জেনে নেয়া প্রয়োজন। রাসূল সা.-এর ইসরা তথা মক্কা শরীফের হাতিমে কাবা থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ ছিল আলমে শাহাদাত বা আলমে খালক তথা জড় জগত কেন্দ্রিক। অতপর মসজিদুল আকসা থেকে সপ্তম আসমানের সিদরাতুল মুনতাহা থেকে নিয়ে মহান আল্লাহর আরশে আযীমকে কেন্দ্র করে যে ভ্রমণ রাসূল সা. করেছিলেন, তা ছিল ঐ আলমে মেলাছ তথা প্রতিরূপ জগতকে কেন্দ্র করে।
আলমে মেছাল বা প্রতিরূপ জগতে যেহেতু নিম্নতর জগত দু’টির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছুই প্রতিবিম্বিত রূপে বিদ্যমান, তাই এই আলমে মেছাল বা প্রতিরূপ জগতে যে প্রবেশ করবে, সে নিম্নতর জগত দু’টির সবকিছুই অবিকল বর্তমানরূপে দেখতে পাবে। হুজুর সা.কে জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীদের বিভিন্ন ঘটনাবলিসহ যা কিছু দেখানো হয়েছিল, তা মূলত ঐ আলমে গায়েব তথা অদৃশ্য জগত ও আলমে মেছাল তথা প্রতিরূপ জগতে প্রবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। আর মক্কার হাতিমে কাবা থেকে মসজিদুল আকসায় প্রবেশের পূর্বেই যেসব ঘটনাবলি দেখানো হয়েছিল, তা কবর পরবর্তী ঘটনা হওয়ার কারণে আলমে মেছাল বা আলমে বরযখের বিষয়বস্ত্ত ছিল। কবরের বাহ্যিক রূপ যেহেতু বস্ত্ত বা জড় জগতে দেখা যায়, সম্ভবত সেই কারণেই ঐসব ঘটনাবলি আলমে মেছালের বিষয় হওয়ার পরেও আলমে শাহাদাত বা জড় জগতে দেখানো হয়েছিল। (আল্লাহই অধিক অবগত)
উপরোক্ত আলোচনার পর এবার আমরা বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্ব সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবো। বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্বও ইসলামী মারেফাত বর্ণিত বিশ্বের মতই তিনটি স্তরে বিভক্ত। বিজ্ঞানের প্রথম জগতটি হচ্ছে জড় জগত বা বস্ত্ত জগত, যা আমাদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। উনবিংশ শতকের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত বিজ্ঞানের কাছে এটাই ছিল একমাত্র জগত। ওজন ও পরিমাপের অধীন জিনিসগুলোই এই জগতের বিষয়। আমাদের এই প্রাকৃতিক জগতটাই হল এই জড় জগত।
বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্বের দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে অতীন্দ্রিয় জগত অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। বিজ্ঞানের ‘অতীন্দ্রিয় জগত’ কথাটি সত্যিই অবিশ্বাস্য। কারণ, সাধারণভাবে প্রচলিত ধারনা হচ্ছে, বিজ্ঞান ইন্দ্রিয় সর্বস্ব এবং তাই ‘বিজ্ঞান’ ও ‘অতীন্দ্রিয়’ শব্দ দু’টো বিপরীত তাৎপর্যবাহী। এক সময়ে অবশ্য তাই ছিল। উনবিংশ শতকের যান্ত্রিক জড় বিজ্ঞান অতীন্দ্রিয় বা আধ্যাত্মিক শব্দগুলোকে মানুষের দার্শনিক ও ধর্মীয় মনোভাব প্রসূত বলে উপহাস করত এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব ছাড়াই সৃষ্টির ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেত। ফলে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বা ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে একটা দূর্লংঘ্য ব্যবধানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে এ ব্যবধান ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে শুরু করে। জড় জগত গঠনকারী দু’টো উপদান ‘পদার্থ ও শক্তি’কে বিজ্ঞান দু’টো স্বতন্ত্র সত্ত্বা বলে মনে করত। তবে এটা আজ একটা স্বীকৃত সত্য যে, ভর ত্যাগ করে পদার্থ যখন আলোর গতিবেগে (সেকেন্ড এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল) ছুটে চলে, তখন তা হয় শক্তি। আবার এই শক্তিই যখন ‘ঘনীভূত’ হয়ে ভরনির্ণয় যোগ্য রূপে দৃশ্য ও গতিহীন হয়ে ওঠে, তখন তা হয় পদার্থ। শক্তি ও পদার্থের এই পারস্পরিক রূপান্তরের লীলাক্ষেত্র হল এই জড় জগত। পদার্থ ও শক্তির অভিন্নতা তথ্য থেকে একটি চিন্তা বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে, এই পদার্থ ও শক্তির কোনটিই যদি স্বতন্ত্র বা প্রাথমিক সত্ত্বা না হয়, তাহলে আসলে এরা কি? তারা চিন্তা করলেন, মানুষের জ্ঞানের কাছে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের মাধ্যমে যা শক্তি, অপর যন্ত্রের মাধ্যমে অন্য সময়ে তাই-ই পদার্থ হয়ে ধরা পড়ে, তখন এরা অবশ্যই এমন অপর কোন তৃতীয় সত্ত্বার বিভিন্নরূপ প্রকাশ, যে সত্ত্বা সর্বপ্রকার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতির তথা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জানার বাইরে। এখানে এসেই দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মবিশ্বাসীরা এক হয়ে যান। বিজ্ঞানের এই স্তরটির নাম হল ‘অতীন্দ্রিয় জগত’।
এরপর বিজ্ঞানের তৃতীয় জগতের অস্তিত্বের সন্ধান বিজ্ঞানীরা অতি ইদানিংকালে পেয়েছে। এটি হচ্ছে ঋণাত্মক পদার্থ (Anti matter) জগত বা প্রতিরূপ জগত। এটি হচ্ছে ঋণাত্মক পদার্থের বা বস্ত্ত বিপরীত (Anti matter বা Mainus matter) জগত। এ্যান্টি ইলেক্ট্রন, এ্যান্টি প্রোটন প্রভৃতির অস্তিত্বের মতই বস্ত্ত বিপরীত বা এ্যান্টি ম্যাটার সত্ত্বার অস্তিত্ব। যথাসাধ্য অনুসন্ধানের পর এটাও জানা গেছে যে, এই এ্যান্টি ম্যাটার বা বস্ত্ত-বিপরীত সত্ত্বাটি এই প্রাকৃতিক বা জড় জগতের কোথাও অনুপ্রবিষ্ট নেই। কারণ, ম্যাটার ও এ্যান্টি ম্যাটার সহঅবস্থানে অবস্থান করতে পারে না। মহাশুন্যের কোন এক সুদূর লোকে বস্ত্ত জগতের ঠিক বিপরীত এই জগতটি কোথাও না কোথাও বিদ্যমান আছে। সেখানে জড় জগতের সবকিছুই বিপরীতভাবে বিদ্যমান। ঠিক যেন আয়নায় প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। অর্থাৎ এই যে আপনি এই মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, ঠিক এই আপনিই হুবহু এই মুহূর্তে এই ভাবেই ঐ এ্যান্টি ম্যাটার জগতে বিদ্যমান আছেন। আমাদের এই বস্ত্ত জগতের বস্ত্তকে যদি ধনাত্মক বলে মনে করা যায়, তাহলে এই ধনাত্মক সত্ত্বার বিপরীত অর্থাৎ ঋণাত্মক পরমানু দ্বারা গঠিত ঐ প্রতিরূপ জগতে আমাদের এই বস্ত্ত জগতের সব বৈশিষ্ট বিপরীতভাবে বিদ্যমান। এই ছিল বিজ্ঞানের তিনটি জগতের কথা।
ইসলামী মারেফাত বা আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান ও বর্তমান প্রচলিত আধুনিক বিজ্ঞান উভয়ে যে জগত তিনটির কথা বলছে, তা যেন প্রায় অভিন্ন। সামান্য কিছু ব্যাখ্যাগত পার্থক্য ছাড়া তেমন কোন পার্থক্যই যেন উভয়ের মাঝে নেই। এই প্রেক্ষাপটে হুজুর সা.-এর ইসরা ও মিরাজ বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের কাছেও অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। যদিও ইসলামের কোন কিছুর সত্যতাই বিজ্ঞানের স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করে না।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আলোর গতির যত কাছে যাওয়া যায়, ততই সময় শ্লথ হয়ে আসে। আলোর গতি অপেক্ষা বেশি গতিতে গেলে সময় উল্টো দিকে বয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, ‘বোরাক’ শব্দের অর্থ বিদ্যুৎ গতি, যা আলোর গতির চেয়েও দ্রুতগামী। বোরাকের গতিতে অগ্রসর হলে সময় শ্লথ হয়ে আসবে এবং সময় উল্টো দিকে বইবে। গতি বিজ্ঞানের মতে পৃথিবীর কোন বস্ত্তকে প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাৎ প্রায় শত মাইল বেগে উর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেয়া হলে, তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী থেকে কোন বস্ত্ত যতই উপরে উঠবে, ততই তার ওজন কমবে। যার ফলে অগ্রগতি ক্রমেই সহজ হয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবী থেকে কোন বস্ত্তর দূরত্ব যতই বাড়ে, ততই তার ওজন কমে। পৃথিবীর ১ পাউন্ড ওজনের কোন বস্ত্ত ১২ হাজার মাইল উর্ধ্বে মাত্র এক আউন্স হয়ে যায়। এ থেকে বলা যায়, পৃথিবী থেকে যে যত উর্ধ্বে গমন করবে, তার ততই অগ্রগতি হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে হুজুর সা.-এর ইসরা ও মিরাজের সফর বিবেচনা করা হলে, তা অস্বীকার করার উপায় আছে কি?
এই প্রবন্ধে যা কিছু বলা হল, তাকে ইসরা ও মিরাজের বা অন্যান্য বিষয়ের ‘একমাত্র বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ বলে মনে করা ঠিক হবে না। এরূপ ধারণা করাও ঠিক হবে না যে, ইসরা ও মিরাজ ঠিক এভাবেই ঘটেছিল। বরং ইসরা ও মিরাজের সত্যিকার স্বরূপ একমাত্র মহা পরাক্রমশালী, চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এবং তাঁর রাসূল সা.ই জানেন। আমরা শুধু আমাদের সীমিত চিন্তা, সীমিত জ্ঞান দিয়ে ব্যাকুল ও অস্থির হৃদয়কে শান্ত্বনা দিয়ে থাকি মাত্র। আল্লাহু আকবার।
লেখক,মাওলানা কাজী ফজলুল করিম।
মুহাদ্দিস ও খতীব, কারবালা মাদরাসা, বগুড়া।